Shopping cart

থমকে আছে প্রকল্পের কাজ, নানা শঙ্কায় মাঠে নেই ঠিকাদাররা।

সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

বৈষম্য’বিরোধী আন্দোলনের সময় ভাঙচুরে-আগুন ক্ষতিগ্রস্ত গাজীপুরে বিআরটি (BRTA) প্রক’ল্পে এখনও কাজ শুরু হতে দেখা যায়নি।

ময়মনসিংহ থেকে নিজস্ব গাড়িতে রাজধানীতে যাচ্ছিলেন ‘তৌসিফ আহমেদ’। প্রায় ৩০-৪০ মিনিট ধরে আটকে আছেন গাজীপুর চৌরাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালে। বিরক্তি নিয়ে এ পথে নিয়মিত চলাচল’কারী এই ব্যক্তি বললেন, এই ফ্লাইওভারের কাজটা হয়ে গেলে কোনো জ্যাম ছাড়া বিরক্তকর এ জায়গা থেকে কত সুন্দর করে চলে যাওয়া যেত। সবসময় এখানে মাত্র এক কিলো যেতে ৩০-৪০ মিনিট সময় বেশি লেগে যায়।

তৌসিফ আহমেদ’ তিক্ততা প্রকাশ করলেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন গাজীপুরের বাসিন্দা ‘জীবন হাসান’। বলেন, “গত ১০ বছর ধরে দেখতেছি এই জায়গায় জ্যাম লাগেই থাকে। আর ৫ বছর ধরে দেখতেছি ফ্লাইওভারের কাজ করতেছে। কিন্তু কাজের শেষ দেখতে পাচ্ছি না। ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল শুনছিলাম। কিন্তু সরকার পতনের পর থেকে আর ফ্লাইওভারের কাজ করতে দেখি না। দুর্ভোগ যে শেষ হবে কবে আল্লাই জানে।

ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের আগে ও পরের সহিংসতার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিআরটি (BRT) প্রকল্পের কাজ আর শুরু হয়নি। যানজট কমাতে চলমান গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ঠিকা’দার ও সাব- ঠিকা’দারদের কর্মীদের আর কাজে দেখা যাচ্ছে না। শুধু এ প্রকল্প নয়, আওয়ামী পতন হওয়ার পরের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলটির প্রভাব’শালী ঠিকা’দারদের যেমন দেখা মিলছে না, তেমনি সরকারের সমর্থন’পুষ্ট ঠিকাদাররাও কাজে নেই। এতে লাখ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ থমকে আছে।

সড়ক থেকে সেবা খাত প্রায় সব জায়’গায় একই অবস্থা। শুধু রাজধানী কিংবা গাজীপুর নয়, দেশের প্রায় সবখানেই ঠিকাদাররা পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিচ্ছেন। এলাকায় এলে ঝামেলায় পড়বেন কি-না কিংবা চলমান কাজের বাকি’টুকু করলে ঠিকঠাক টাকা পয়সা পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ বা সংশয়ে থাকার কথা বলছেন ঠিকাদাররা।

নতুন সরকারের কাছে সাবেক প্রধান মন্ত্রি শেখ হাসিনার সময়ে পাস করানো প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব থাকবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কার শেষ নেই ঠিকা’দারদের মনে।

বড় প্রক’ল্পের পাশাপাশি ছোট প্রকল্পের কাজগুলোও আটকে আছে। হাম’লার আশঙ্কায় আওয়ামী নেতাদের মতোই আত্মগোপনে রয়েছে দলটির অঙ্গ সংগঠন ও আওয়ামী-পন্থি হিসেবে পরিচিত অনেক ঠিকাদার। সরকারের সমর্থন পুষ্ট ঠিকাদাররাও প্রকাশ্যে আসতে সময় নিচ্ছেন। এসব ঠিকাদারদের বড় অংশ মূলত অনেক সময়  ধরে সড়ক ও ড্রেন সংস্কার-নির্মাণের কাজ করে আসছিলেন।

সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে আছে দেশের চলমান উন্নয়ন’মূলক কাজগুলো। যেগুলো কাজ চলছে, সেগুলোও যেন প্রয়োজনের তুলনায় কম লোক দিয়ে চালানো হচ্ছে। এতে ধীর গতিতে প্রকল্পের অগ্রগতি। এছাড়া বন্ধ আছে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনা, চলমান কাজের বিল, আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজের অনুমোদন সহ উন্নয়ন কাজ সম্পর্কিত অনেক কিছুই।

এমতাবস্থায় ঠিকাদাররা জোর দাবি করছেন, কোন কাজটা হবে আর কোনটি হবে না সরকার যেন অতি তারাতাড়ি সে বিষয়ে একটা নির্দেশনা দেয়। কাজ বাতিল হলে বড় ধরনের আর্থিক লস এড়াতে সরকারি ঘোষণা দিকে তাকিয়ে ঠিকাদাররা।

ধীর গতিতে কাজ, দুর্ভোগে মানুষ

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ শেষ করে ডিসেম্বরে গাজীপুরের বিআরটি (BRT) প্রকল্পের পথে যানবাহন চালানোর আশা থাকলেও তা এখন আর হয়ে উঠবে না বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কোটা সংস্কার থেকে সরকার পরিবর্তন আন্দোলনের সময় এ প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক ভাঙচুর চলেছে। এতে অনেক পিছিয়ে গেছে উন্নয়নমূলক কাজ। আর দুর্ভোগে পৌঁছেছে চরমে।

রাস্তা ও জনপথের অধীনে বাস্ত’বায়ন হচ্ছে বিআরটি (BRT) প্রকল্পের গাজীপুর অংশ। প্রকল্প পরিচালক ‘এ এস এম ইলিয়াস শাহ’ বলেন, আন্দোলনের সময় ১৩টি স্টেশনে পোড়ানো হয়েছে। চৌ-রাস্তার কাছে ফ্লাইওভারের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছিল।

“আন্দোলন, সরকার পতন সব মিলিয়ে একটা ইফেক্ট তো আছেই। তবুও ঠিকাদাররা কাজগুলো শুরু করেছে আবার। কাজ পুরোদমে শুরু হতে আরও ১৫-২০ দিন সময় লাগবে।”

প্রকল্প পরিচালক ঠিকাদার’দের কাজে ফেরার কথা বললেও গত সপ্তাহে এ প্রকল্প এলাকা ঘুরে কোথাও কাজ চলমান দেখা যায়নি। এ তথ্য তুলে ধরলে তিনি বলেন, “আপনি হয়ত কোথাও পাবেন না। তবে চৌ-রাস্তাতে ময়মনসিংহ থেকে রাজধানীমুখী ফ্লাইওভারের কাজ চলছে স্থবির ভাবে। অন্যান্য প্রজেক্টে যেভাবে কাজ ধীরগতিতে চলছে এটাও তেমনই।”

এ প্রকল্পের উপর অনেক ঝড় ঝাপ্টা যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “কন্ট্রাক্টর রা হত-ভম্ব হয়ে আছে যে তারা কিভাবে কী করবে। তাদের মালা মালের কেমন ক্ষতি হয়েছে সেটা নির্ধারণ করতেছে। এরপর আমাদের জানাবে। আমরাও চেষ্টা করতেছি কাজ শুরু করানোর জন্য। এখন আমাদের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করছি। এরপর বলা যাবে প্রকল্প কতদিনে শেষ হয়।

এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মোট সাড়ে বিশ কিলোমিটার রাস্তার এই প্রকল্পে ফ্লাইওভার নয় টি ও স্টেশন রয়েছে পঁচিশটি, যেগুলোর মধ্যে তের টিই আগুনে পোড়ানো হয়েছে।

ঢাকাতে জাতীয় সংসদ থেকে সংসদ সদস্যদের আবাসিক এলাকায় যাওয়ার আন্ডার পাসটির নির্মাণ কাজও সরকার পরিবর্তনের সময় থেকেই বন্ধ রয়েছে। বর্তমান অবস্থা জানতে সেখানে কথা বলতে চাইলে দায়িত্বশীল কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় নাই। কতটুকু কাজ বাকি জানতে প্রকৌশলী’দের খোঁজ করেও সেখানে তাদের দেখা মেলেনি।

প্রকল্প এলাকার আশ পাশে ঘুরছিলেন নিরাপত্তা কর্মী ‘আব্দুর রউফ মিয়া’। কথা হলে দৈনিক সারাদেশ কে  তিনি বলেন, ”কাজ এহন বন্ধ আছে। আমারে রাখছে খালি দেহা শোনা করার জন্য । কাজের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।

সংসদ ভবন এলাকার আশপাশে রিকশা চালান হারুনুর রশীদ। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে তিনি আন্ডারপাস প্রকল্পের ভেতরে-বাইরে কোনো লোককে কাজে দেখেননি রিকশা চালক হারুনুর রশিদ।

দেশের বড় ঠিকাদারি কোম্পানির ১ টি তমা কনস্ট্রাকশন, যেটির অধীনে সিলেট, ডেমরা ও কক্সবাজার সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় উন্নয়নমূলক প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে সবগুলো কাজেই থমকে আছে। এর বড় কারণ হিসেবে কোম্পানিটির নাম প্রকাশ না করার শর্তে যান্ত্রিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের অন্যান্য কাজের যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন আমাদেরও একই অবস্থা। আর আন্দোলনের সময় প্রকল্প গুলোয় টুকটাক ইনসি’ডেন্স হয়েছে।

তবে আগের সরকারের সময়ে প্রভাবশালী ঠিকাদার কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তমা কনস্ট্রাকশনের কাজ বাতিল হবে না বলে মনে করেন তিনি।

তার কথায়, “দেশের বাইরের ফান্ডিংয়ে ও জন সাধারণের জন্য যে কাজ হয় সেটা তো বাতিল করার কিছু নাই। এটা নিয়ে আমাদের টেনশন নাই। অনেক নতুন কাজের টেন্ডার হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো হবে কি না, না কি পরে হবে সেটা ঠিকা’দারদের আলাদা চিন্তার বিষয় আছে।

ঢাকায় অনেক যায়গায় ড্রেনেজ লাইন নির্মাণের কাজ অর্ধেকের কাছাকাছি কাজ হয়েছিল। আন্দোলন আর সরকার পরিবর্তনের  পর এখন কাজ গতি হারিয়েছে।

নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ঠিকাদার আওয়ামী-পন্থি হওয়ায় বর্তমান সরকারের কাছে তার কাজ টিকবে কিনা এমন শঙ্কায় ছিলেন। পরে আরেক দলের পরিচিতি এক কর্মীকে কাজটা করতে দিয়েছেন, যাতে কাজটা বাদ না যায়। যাকে কাজটা দিয়েছেন তার সঙ্গে শর্ত হচ্ছে- লভ্যাংশ থেকে তাকেও একটা অংশ ভাগ দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ”আমি যে এই টেন্ডারের কাজ করব, এটা পরে বাতিল করে দেয় কিনা সেই ভয়ে আছি। দায়িত্ব’শীল কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারছি না যে আমার কাজটা নিয়ে আগাবো কি না। সাবেক সরকারের অধীনে নির্বাচন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বাদ দিচ্ছে। এই অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলো টিকে কিনা সেটা বলা বাহুল্য ।”

স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ণ ও পরিদর্শন (আই এম ই ডি) অনুবিভাগের মহা-পরিচালক “মো. মাহমুদুল হাসান” বলেন, ঠিকাদারদের কাজের গতি বুঝতে তাদের আরেকটু সময় লাগবে।

(আইএমইডির) এ কর্মকর্তা বলেন, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে তাদের অনুমোদিত প্রকল্প কাজ ২২৭টি। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সবগুলোই চলমান রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ৫ শতাংশ হয়েছে আবার কিছু ৯৫ শতাংশও হয়েছে এমন আছে। আগামী বছরের জুন মাসে এই অর্থ বছর শেষে ৪০-৫০ টি প্রকল্প শেষ হবে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী “মোহাম্মদ মাহবুব আলম” বলেন,

বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে ছোট-বড় মিলিয়ে ১২৬টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কতগুলো কাজ শেষ হয়েছে সেটার তালিকা আরও পরে হয়। কিছু প্রকল্প আছে এখন কাজ শেষের দিকে, আবার কিছু প্রকল্প আছে কাজ অনেক বাকি।

ঠিকা’দাররা কাজ ভালো করলে ভালোভাবে পেমেন্ট পাবে। আমাদের টেন্ডারের শর্ত মেনেই তাদের কাজ করতে হবে। ঠিকাদাররা স্পষ্ট জানেন বরাদ্দ আছে কিনা। আর আমাদের বরাদ্দ না থাকলে আমরা কাজ করতে বলি না। আমরা ঠিকাদারদের সবসময় তাড়া দেই কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করেন। মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে।”

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনের ১২৬টি প্রকল্পে কতজন ঠিকাদার রয়েছে সেটা তিনি বলতে পারেননি।

(সিপিডির) সম্মানীয় ফেলো “মোস্তাফিজুর রহমান” বলেন, যে প্রকল্প গুলো চলতেছে এগুলো রিভিও করতে হবে। কোনটা কোন পর্যায়ে আছে বা প্রকল্প কি ধরনের, সেখানে অর্থায়ন করতে হবে। এখন তো অর্থেরও টান। কোনটা স্থগিত রাখা হবে, কোনটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে সেগুলো নিয়ে যাচাই বাছাই করতে হবে, আর সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নিতে হবে।

অনেক কাজ আছে যেগুলোর প্রয়োজনই ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এমন জায়গায় একটা পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো বন্ধ করে দিলেই দেশের জন্য উপকার হবে। এই বিষয়ে যাচাই-বাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *